নিরুপমা

Rakhi Majumder Tewary

দামি সেগুন কাঠের পালঙ্কে বসে  লাল কাপড়ের কুঁচি লাগানো তাল পাতার পাখায় হাওয়া করছেন নিরুপমা দেবী ৷কোলে ওনার দেড় বছরের ঘুমন্ত নাতি ৷পানের ডাবরটা পাশেই নিয়ে বসেছেন তিনি ৷সামনের তক্তাপোষে সুদৃশ্য হাতে বোনা সুতোর নকশা তোলা চাদর পাতা ৷ছোট বৌমা ওখানে বসে রবি ঠাকুরের গল্প পড়ে শোনাচ্ছে ৷ শ্বশুর বংশের জমিদারি এখন আর না থাকলেও সেই বনেদিয়ানা এখনও রয়েছে এই পরিবারে ৷বাড়ির সাজসজ্জাতে এখনও সেই মুন্সিয়ানা অটুট ৷রায় চৌধুরী বাড়ির গত প্রজন্মের একমাত্র পুত্রবধু নিরুপমা দেবীর হাব ভাবও জমিদার গিন্নির মতই ৷তবে মনে মনে উনি জানেন এই সংসার থেকে উনি ঠিক কতখানি পেয়েছেন ৷



এককালে চার চারটে রায় বাঘিনী ননদ ও জাঁদরেল শ্বশুর শ্বাশুড়ি নিয়ে সংসার করলেও এখন উনি সংসারের কর্ত্রী ৷তবে মাথার উপর এখনও জাঁদরেল স্বামী রথীন্দ্রনাথ বাবু দোদন্ডপ্রতাপে বিরাজ করছেন ৷সংসারে ওনার উপস্থিতিটা সময়ে সময়ে মনে করাতে ভোলেন না উনি ৷তাই চাবির গোছার মালকিন হলেও কর্তা রথীন্দ্রনাথ বাবুই সংসারের সর্বেসর্বা ৷ঈশ্বরের কৃপায় নিরুপমা দেবীর কোল আলো করে এসেছিল দুই  পুত্র ও দুই কন্যা ৷


কালের নিয়মে বড় হয়েছে সন্তানরা ৷দুই ছেলে জ্যোতিন্দ্র আর মহেন্দ্র এখন সুপ্রতিষ্ঠিত ও বিবাহিত ৷দুই কন্যাও শ্বশুর বাড়ি পাড়ি দিয়েছে বছরখানেক হলো ৷দুই পুত্রবধু সর্বদা তৎপর শ্বশুর শ্বাশুড়ির সেবায় ৷দেড় বছরের নাতি ঘরময় ঘুরে বেড়ায় ৷মুখখানা তার গোপাল ঠাকুরের মত৷ এমন সুখের সংসারে জ্যৈষ্ঠ মাসের দুপুরে নিরুপমা দেবী পালঙ্কের উপর পানের ডাবর আর কোলে নাতি নিয়ে বসে বৌমার মুখে গল্প পাঠ শোনা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই ৷নিজের স্বর্গীয় শ্বাশুড়ির কাছ থেকে যেটুকু শিখেছেন তিনি তাতেই দুই বৌমাকে বেশ আয়ত্তে রেখেছেন আজও ৷



তবে ছোট বৌমা মোহনা স্বভাবে একটুখানি মুখরা ৷কথা বলতে ছাড়েনা সে কাউকেই ৷পেটে তার বিদ্যেও আছে ৷রূপ আর গুণেও কার্পণ্য করেননি ভগবান তাকে ৷মাঝে মাঝে তার কথা বার্তা আর যুক্তি যেন চোখ খুলে দেয় নিরুপমা দেবীর ৷মোহনা এখন দেড় বছরের পুত্র সন্তানের মা ৷কিন্তু বড় বৌমা পারুল নির্বিবাদী মানুষ ৷মুখচোরা স্বভাব তার ৷পেটে বিদ্যে তেমন না থাকলেও রূপ ও হাতের গুণ দুইই ছিল তার এককালে ৷সারাদিন সংসারের ঘানি টেনেও  মুখে সে রা কাটেনা আজও ৷তবে দিন দিন তার শরীরটা কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে ৷চোখের কোলে কালি আর ভগ্ন স্বাস্থ্য দেখে নিরুপমা দেবীরও  মনটা খারাপ হয় ৷বিয়ের পাঁচ বছর কেটে গেলেও মা হতে পারেনি সে ৷তবে জায়ের ছেলেটা যেন তারই সন্তান ৷আদরে আদরে ভরিয়ে রাখে তাকে ৷দুই জায়ে মিল আছে এটা দেখেই শান্তি পান নিরুপমা দেবী ৷



তবে কিছু না কিছু অশান্তি বোধহয় ভগবান দিয়েই থাকেন প্রত্যেক  সংসারে ৷নিরুপমা দেবীর সংসারেও আপাত শান্তির মাঝেও বড় অশান্তি দেখা দিয়েছে আজকাল ৷


বড় ছেলে জ্যােতিন্দ্র সুউপায়ী হলেও স্বভাব তার ভালো নয় মোটেই ৷তার উপর বাবার মত তারও মেজাজ থাকে সপ্তমে ৷বৌমার সঙ্গে দিন দিন তার দুর্ব্যবহার বেড়েই চলেছে ৷যখন যা মুখে আসে বলতে পিছপা হয়না সে ৷কারনে অকারণে বৌমার গায়েও হাত তোলে জ্যোতিন্দ্র ৷ নিরুপমা দেবীর বড় ননদের এক দুর্সম্পকের মামা শ্বশুরের বাড়িতেও জ্যোতিন্দ্রর অবাধ যাতায়াত আছে ৷বিবাহ যোগ্যা কন্যা আছে সেই বাড়িতে ৷সব বোঝেন নিরুপমা দেবী ৷তবুও না দেখার ভান করে থাকেন তিনি ৷সব কথা কানে এলেও না শোনার ভান করে থাকেন ৷অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে হলেও মুখ বুজে থাকেন নিরুপমা দেবী ৷আসলে নিজের শ্বাশুড়ির মত কঠোর শ্বাশুড়ি হতে চাইলেও মনটাকে কিছুতেই তেমন কঠোর করে তুলতে পারেননি আজও ৷ওনার দুই মেয়েও এই নিয়ে অনেক কানমন্ত্র দেয় মাকে, নিজের অবস্থান ঠিক রাখার ব্যাপারে ৷কিন্তু তখনই নিজের রায় বাঘিনী চার ননদের মুখগুলো ভেসে উঠে চোখের সামনে ৷মনটা কেমন যেন ব্যাকুল হয়ে উঠে নিরুপমা দেবীর ৷তবে এসব  বৌমাদের বুঝতে দেবার মত বোকামী করেননা তিনি ৷তাই ছেলে বৌমার অশান্তির মাঝে নিজেকে টেনে নেওয়া থেকে বিরত থাকেন নিরুপমা দেবী ৷



দু-একবার স্বামী রথীন্দ্রনাথ বাবুর সাথে  বড় খোকার বিষয়টা নিয়ে  আলোচনা শুরু  করেছিলেন  নিরুপমা দেবী ৷কিন্তু স্বামীর ধমকে থামতে হয়েছে ওনাকে ৷

“তুমি চুপ করো ৷অশান্তি  করবে  না ত কি করবে শুনি ! তাল পাতার সেপাইয়ের সাথে কি সংসার করা যায় !একটা ছেলেপুলে ও হলো না ৷শিবু ঘটক ঠকিয়ে দিল আমাদের ৷রোগা মেয়ে ঘাড়ে চাপিয়ে পরপারে গিয়ে লুকিয়ে আছে ৷বাপ মাও মরে গেছে মেয়েটার ৷না হলে কবেই বিদেয় করে পাঠিয়ে দিতাম বাপের বাড়ি ৷”

হেমন্তের বাতাসের মত শিরশিরে একটা বাতাস বয়ে যায় নিরুপমা দেবীর মনে ৷আমতা আমতা করে স্বামীর কথার উত্তরে বলেছিলেন,

“এ আবার কি কথা ! ছেলেপুলে হলো না বলে বিদেয় করে দিতে হবে বড় বৌমাকে !”

স্ত্রীর কথা শুনে ঝাঁঝিয়ে উঠেছিলেন রথীন্দ্রনাথ বাবু ৷

“আমাদের জমিদার বংশ ৷এই বংশের পূর্ব পুরুষরা অনেকেই দুই বার দার পরিগ্রহ করেছিলেন ৷প্রয়োজন হলে বড় খোকার আবার বিয়ে দেব আমি ৷”

প্রতিবাদের ভাষা জানেননা  নিরুপমা দেবী ৷চলনে বলনেই জমিদার বংশের বউ তিনি ৷সংসারে ওনার অবস্থানটা উনিই জানেন শুধু ৷যা কিছু ক্ষমতা প্রদর্শন করার সুযোগ দুই বৌমা ও চাকর বাকরদের উপরই প্রয়োগ করেন নিরুপমা দেবী ৷এই সংসারে কলকাঠি যে নাড়ানোর ক্ষমতা ওনার নেই তা উনি বেশ ভালই বোঝেন ৷শ্বশুরের বংশের অনেক কুকীর্তির কথাও জানা আছে ওনার ৷স্বামীর কুকর্মও সব জানতেন ৷তবুও এই সংসারে পড়ে আছেন সেই কবে থেকে ৷তাই আর কথা বাড়াননি নিরুপমা দেবী ৷তবে বুকের মাঝে একটা কষ্ট আজও বয়ে বেড়ান তিনি ৷


ছোটবেলা দুই এক পাতা লেখা পড়া শুরু করেছিলেন নিরুপমা দেবী ৷তারপরই উচ্চ বংশের সম্বন্ধটা এসেছিল ৷রথীন্দ্রনাথ বাবুর মত বংশের একমাত্র পুত্র সন্তানের সাথে মেয়ের বিয়েটা দিতে পেরে ধন্য হয়ে গেছিলেন নিরুপমা দেবীর বাবা মা ৷লেখা পড়ার তেমন প্রয়োজন পড়েনি এতকাল ৷কিন্তু ছোট বৌমা মোহনা এ বাড়িতে আসার পর থেকেই নিরুপমা দেবীর পড়াশুনার প্রতি আবার আগ্রহ জেগেছে ৷ছোট বৌমা শিক্ষিত মেয়ে ৷অবসরে অনেক বই পড়ে সে ৷ছোট খোকা মহেন্দ্রর চরিত্র জ্যোতিন্দ্রর থেকে একেবারেই আলাদা ৷ কলেজে পড়ায় সে ৷তারও জগত জুড়েও বই আর বই ৷



আজকাল দুপুরগুলো ছোট বৌমার কাছে গল্প শুনেই কাটে নিরুপমা দেবীর ৷আজ দুপুরে “দেনা পাওনা” গল্পটা পড়ে শোনাচ্ছে ছোট বৌমা মোহনা ৷গল্পের চরিত্রের নামও নিরুপমা ৷গল্প শুনতে শুনতে অসহায় নিরুপমার সাথে কেমন একাত্ম হয়ে যান রায় চৌধুরী বাড়ির গিন্নি নিরুপমা দেবী ৷চোখ দুটো ওনার ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে ৷গলার কাছটায় এক টুকরো কান্নার মেঘ আটকে থাকে ৷গল্প পড়া শেষ হতেই বুকটা হু হু করে উঠে নিরুপমা দেবীর ৷


বারান্দায় চোখ যেতেই নিরুপমা দেবী দেখেন বড় বৌমা পারুল ঝুড়ি থেকে পাকা আম বাছাই করে দিচ্ছে রাণীর মাকে ৷রাণীর মা এই বাড়ির সব সময়ের কাজের লোক ৷সে মস্ত বড় বটি দা পেতে আম কাটছে ৷পাকা আমের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে ৷দু-একটা মাছি এসে জুটেছে রাণীর মায়ের বটির কাছে ৷বিরক্ত হয়ে হাত নাড়াচ্ছে সে ৷হঠাৎ কোথা থেকে যেন বড় খোকা জ্যোতিন্দ্র পৌঁছে গেল সেখানে ৷তার চিৎকার চেঁচামেচিতে রাণীর মা বটি ফেলে চলে গেল আড়ালে ৷ঠিক কি নিয়ে বড় খোকার মাথায় আগুন ধরেছে বুঝতে পারলেন না নিরুপমা দেবী ৷কিন্তু বড় বৌমার অসহায় মুখটা দেখে পালঙ্কে আর বসেও থাকতে পারলেন না তিনি ৷নাতিকে বিছানায় শুইয়ে পালঙ্ক থেকে নামলেন ৷ততক্ষণে বড় খোকা বড় বৌমার চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টেনে উঠোনে নেমে গেছে ৷ছোট বৌমা মোহনা ছুটলো সেই দিকে ৷যদিও ভাসুরকে এড়িয়ে চলে সে ৷কিন্তু আজ কাউকে তোয়াক্কা না করে রাণীর মায়ের কাত করে রাখা বটি দা টা হাতে তুলে নিল সে ৷

“দিদিকে ছেড়ে দিন দাদা ৷নাহলে ছুঁড়ে দেব বটি টা ৷”

ভূত দেখার মত চমকে উঠে জ্যোতিন্দ্র ৷পারুলের চুলের মুঠি ছেড়ে দেয় সে ৷তখনই রথীন্দ্রনাথ বাবু উঠোনে এসে দাঁড়ান ৷বজ্রের মত হুংকার করে বলেন,

“তোমার এত বড় সাহস ছোট বৌমা ? তুমি ভাসুরকে অস্ত্র দেখাচ্ছো !এটা আমার বাড়ি ৷এখানে এসব অরাজকতা আমি হতে দেবো না ৷”

মোহনা মুহুর্তেই উত্তর দেয় ৷

“এ বাড়িতে নারীর উপর নির্যাতন আমিও আর হতে দেবো না ৷এই বংশে আগে যা হয়েছে সেসব অতীত ৷এখন আর এসব ঘরোয়া হিংসা চলবে না কিছুতেই ৷”

নিরুপমা দেবীর দু’চোখ জ্বলছে আক্রোশে ৷স্বামীর অনেক ব্যাভিচারও সহ্য করেছেন তিনি এককালে ৷মুখ খুলতে পারেননি ভয়ে ৷আজ সব ভয় উধাও হয়েছে মোহনাকে দেখে ৷ছোট বৌমার হাত থেকে বটি দা টা কেড়ে নেন তিনি ৷

“দেখি ত তুই কি করে হাত তুলিস বৌমার গায়ে ৷তোর হাত আমি কেটে ফেলবো, এই আজ বলে দিলাম ৷ভালো না লাগলে বাড়ি ছেড়ে চলে যা ৷কিন্তু এই বাড়িতে থেকে আমি বৌমার উপর অত্যাচার হতে দেবো না ৷আর যে বড় খোকার সঙ্গ দেবে সেও সাবধান থাকুক, এই আমি বলে দিলাম আজ …”

থরথর করে ঠোঁট দুটো কাঁপতে থাকে নিরুপমা দেবীর ৷


চমকে উঠেন রথীন্দ্রনাথ বাবু ও জ্যোতিন্দ্র ৷ এ কোন অপরিচিতা নারী সামনে দাঁড়িয়ে আছেন !রথীন্দ্রনাথ বাবু ওনার লাইসেন্স করা রাইফেলটা আনতে গিয়েও থমকে দাঁড়ান ৷ওনার দুই হাঁটু যেন অবশ হয়ে গেল মুহুর্তেই ৷


মোহনা মনে মনে নিশ্চিন্ত হয় ,এতদিনে প্রতিবাদ করতে শিখেছেন শ্বাশুড়ি মা নিরুপমা দেবী ৷আর মুখ বুজে অনাচার সহ্য করে হারিয়ে যাবেনা নিরুপমারা ৷সত্যিই শারীরিক ত্রুটি না থাকলেও নিরুপমারা যে মনের জানালা বন্ধ করে বোবা আর কালা সেজে থাকেন আজীবন ধরে ৷চোখের সামনে অন্য নারীর নির্যাতন দেখে সহ্য করেন ওনারা ৷নিজেদের যন্ত্রনাও লুকিয়ে রাখেন বুকের ভিতর ৷বিড়বিড় করে মোহনা বলে,

“এভাবেই গর্জে উঠুক নিরুপমারা ৷এইভাবেই বেঁধে বেঁধে থাকুক নারীরা ৷এইভাবেই হাতে হাত ধরে এগিয়ে চলুক সব নারী ৷”

সমাপ্ত

(আমার লেখা ভালো লাগলে আমাকে মমস্প্রেসো বাংলায় অনুসরণ (ফলো) করার ও আমার লেখা শেয়ার করার অনুরোধ জানালাম ৷)



#আমার_লেখনীতে
#কবির_কল্পনায়

Disclaimer:    The opinions expressed in this post are the personal views of the author. They do not necessarily reflect the views of Momspresso.com. Any omissions or errors are the author’s and Momspresso does not assume any liability or responsibility for them.

Scroll to Top